রাসেলস ভাইপার সহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে কি করনীয় জেনে নিন

২০০৯ সালে WHO কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে অবহেলিত ক্রান্তীয় রোগ গুলির (Neglected Tropical Disease) মধ্যে একটি হলো সাপে কাটা। ক্রান্তীয় অঞ্চলের দেশ গুলোতে সাপে কাটা জনস্বাস্থ্যের একটা জ্বলন্ত সমস্যা। ভারত উপমহাদেশেও সমস্যাটি খুব গভীর।

রাসেলস ভাইপার সহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে কি করনীয় সম্পর্কে জেনে নিন


ভারত উপমহাদেশে প্রত্যেক বছর প্রায় ৩৫০০০-৫০০০০ মানুষ মারা যায় সাপের কামড়ে। ভারত সরকারের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সালে সাপের কামড়ে ১৩৩১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।আবার অন্য এক বেসরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতবর্ষে সাপে কাটায় বছরে ৪৫৯০০ মানুষের মৃত্যু হয়। আজ আলোচনা করব রাসেলস ভাইপার সহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে কি করনীয় এ বিষয়ে।

ভূমিকা

ভারত উপমহাদেশে প্রায় ২৫০ প্রজাতির সাপ আছে। তার মধ্যে ৫২ টি প্রজাতি বিষধর। আবার এদের মধ্যে ৪০ টিরও বেশি প্রজাতির সাপ সমুদ্রে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে কেবলমাত্র ৬ টি প্রজাতির বিষধর সাপ পাওয়া যায় যার মধ্যে ৩ টি প্রজাতির সাপের কামড়ে ৯৯% মানুষের মৃত্যু হয়। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় সাপটি চেনা থাকলে তা চিকিৎসায় সাহায্য করে তবে তা অপরিহার্য একথা বলা যায় না। 
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাপকে চেনা সম্ভব হয় না। কালাচ সাপ বেশিরভাগ সময় গভির রাতে মেঝেতে ঘুমানোর সময় কামড়ায় এবং এদের কামড় বেদনাহীন। ফলে প্রায় ৫০% এই ধরনের রোগী সাপের কামড়ের কথা বলতেই পারে না। এদের চিকিৎসার সময় সাপের কামড়ের উপসর্গগুলি শরীরে দেখে চিকিৎসা করা হয়। চলুন এ বিষয়ে জেনে নেয়া যাক রাসেলস ভাইপার সহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে কি করনীয়।

বিষধর সাপ চিনব কিভাবে?

আমরা প্রথমে বাংলাদেশের ৬ টি বিষধর সাপ চিনে নেয়ার চেষ্টা করব। তাদের কামড়ে কী কী রোগ লক্ষন দেখা যায় তা জানার চেষ্টা করব।প্রানীবিদ্যা বিশারদ না হয়েও চিকিৎসার জন্য সামান্য কয়েকটি জিনিস জানতে হবে।
চিকিৎসার পরিভাষায় সাপেদের দু'ভাগে ভাগ করা হয়।নিউরোটক্সিক আর হিমোটক্সিক। নিউরোটক্সিক সাপ আবার ২ রকম ফণাযুক্ত আর ফনাহীন। ফনাযুক্ত শঙ্খচুড় বা কিং কোবরাও এ জাতীয় সাপ।

নিউরোটক্সিক সাপ ( ফনাযুক্ত)

গোখরো ও কেউটে সাপ 

ফণাযুক্ত গোখরো আর কেউটে চিকিৎসার ক্ষেত্রে একই সাপ। এদের বিষ নিউরোটক্সিক। ফণা যুক্ত এই সাপ দুইটিকে আমরা সবাই চিনি। এদের কামড়ের লক্ষন হলো প্রচন্ড ব্যাথা ও ক্রমবর্ধমান ফোলা। গোখরো সাপের পিছনে ইংরেজি ইউ অক্ষরের মত একটি চিহ্ন থাকে। একে খরম চিহ্নও বলা হয়।
গোখরো ও কেউটে সাপ


কেউটে সাপ

কেউটের পিছনে থাকে পদ্ম চিহ্ন। নিউরোটক্সিক এই সাপের কামড়ে রোগী ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়বে, দুই চোখের পাতা পড়ে আসবে। রোগী ঝাপসা দেখবে। কথা জড়িয়ে আসবে।
কেউটে সাপ


শঙ্খচুড় বা কিং কোবরা

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফণাধর সাপ। পশ্চিমবঙ্গে ও দক্ষিণবঙ্গে এদের কম দেখা যায় তবে উত্তরবঙ্গে গভির জঙ্গলে এদের দেখা মেলে। এদের ক্ষতি করার ক্ষমতা কোবরা গোষ্ঠীর অন্য সাপদের মতই। বিষ নার্ভের মধ্যে প্রবেশ করে মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। তবে বড় সাপ হওয়ায় অন্য কোবরা সাপের তুলনায় ১০ গুন বেশি বিষ একটা কামড়ে শরীরে প্রবেশ করে। সে কারনে এদের কামড়ে চিকিৎসাতেও ১০ গুন বেশি এভিএস লাগে।
শঙ্খচুড় বা কিং কোবরা


নিউরোটক্সিক সাপ ( ফণাহীন)

ফণাহীন নিউরোটক্সিক সাপের কামড়ে ব্যাথা ফোলা হবে না। চোখের পাতা পড়ে আসা এ ক্ষেত্রে প্রধান লক্ষন। এক্ষেত্রেও কথা জড়িয়ে আসবে আর রোগী ঝিমিয়ে পড়বে। ফোণাহীন নিউরোটক্সিক সাপ হলো কালাচ আর শাঁখামুটি। এদের ইংরেজিতে বলা হয় ক্রেট (Krait)

শাঁখামুটি সাপ

শাঁখামুটি সাপটি চেহারায় বেশ বড়, গায়ের রঙ উজ্জ্বল হলুদ আর কালোর পর পর ব্যান্ড। খুবই শান্ত প্রকৃতির এই সাপ সাধারনত মানুষকে কামড়ায় না।পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই সাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারন এরা ভয়ংকর কালাচ সাপ খেয়ে তাদের সংখ্যা কমায়।
শাঁখামুটি সাপ


কালাচ সাপ

কালাচ একটি ভয়ংকর বিষধর, রহস্যময় সাপ। ফণাহীন মাঝারি চেহারার এই সাপটির গায়ের রঙ কালো, কালোর উপর সরু সরু সাদা ব্যান্ড বা চুড়ি লেজের শেষ পর্যন্ত থাকে। দিনের বেলায় এদের প্রায় দেখাই যায় না। প্রায় সব ক্ষেত্রে এরা রাতে খোলা বিছানায় কামড়ায়। এরা কেনো খোলা বিছানায় উঠে আসে তা এখনও অজানা। এদের কামড়ে কোনো ব্যাথা হয় না এজন্যই এরা রহস্যজনক সাপ। 
অতি সূক্ষ্ম কামড়ে দাগ প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না। রাত্রে বিছানায় কামড়ের ২-২০ ঘন্টা পর নার্ভে বিষের লক্ষন দেখা দেয়। বিচিত্র সব রোগের লক্ষন নিয়ে রোগী হাসপাতালে আসে। ভোর রাত্রে পেট ব্যাথায় জন্য ঘুম ভেঙ্গে যায়।
কালাচ সাপ


এছাড়া গলা ব্যাথা, গাঁটে গাঁটে ব্যাথা, খিঁচুনি শুধুমাত্র দুর্বলতা অনুভব করা এরকম বিচিত্র সব লক্ষন নিয়ে রোগী আসতে পারে। এসব লক্ষনের সাথে আগের রাত্রে মেঝেতে ঘুমানো এবং পরে দুই চোখের পাতা পড়ে আসছে দেখলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় কালাচ সাপ কামড়েছে।

হিমোটক্সিক বা রক্তক্ষরনকারী সাপ

এধরনের সাপ এর কামড়ে শরীরের রক্ত কনিকা গুলো ভেঙে যায়। যার ফলে রক্ততঞ্চন বা রক্ত জমাট বাধতে পারে না। দ্রুত কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত বেড়িয়ে আসে যেমন: নাক, মুখ, প্রসাব ইত্যাদি। কামড়ের স্থান ফুলে যায় আর প্রচন্ড ব্যাথা হয়।

রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ

সাপের নাম রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া। এটি বাংলাদেশে সর্বাধিক উৎপাতকারী সাপ।বর্তমানে এই রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে সব থেকে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এই সাপটি মোটা চেহারার, বাদামী বা কাঠ রঙ এর এবং ফোণাহীন সাপ।গায়ে চন্দন হলুদ চাকা চাকা দাগ দিয়েই এদের সহজে চেনা যায়।
রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ


রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে রোগীর রক্ত তঞ্চণের গন্ডগোল দেখা যায়। চিকিৎসা দেরী হলে রোগীর কিডনি নষ্ট হতে থাকে, মূত্রে রক্ত এসে যায়। এর কামড়েও গোখরোর কামড়ের মত ব্যাথা হয় আর ক্রমবর্ধমান ফোলা প্রাথমিক লক্ষণ।দাঁতের মাড়ি বা পুরাতন ঘা থেকে বা কাশির সঙ্গে রক্তপড়া ও রক্ততঞ্চণ এর গন্ডগোল হয়। রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া একমাত্র হিমোটক্সিক সাপ যার কামড়ে চোখের পাতা পড়ে আসে।

রাসেলস ভাইপার সহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে কি করনীয় 

সাপে কামড়ালে করনীয় হলো প্রথমে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া। প্রাথমিক চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলো দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে পৌছে নির্দিষ্ট চিকিৎসার আগে রোগীর ক্ষতির পরিমান যতটা সম্ভব কমানো। প্রচলিত অনেক প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগীর উপকারের থেকে ক্ষতি বেশি হয়।তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বা হচ্ছে।
  • রোগীকে আশ্বস্ত করুন। সাপে কামড়ালে প্রথম করনীয় হলো রোগীকে আশ্বস্ত করা। যে কোনো মানুষকে সাপে কামড়ালে মানুষ ভেবেই নেন যে তাকে বিষধর সাপ কামড়েছে। আর 'বিষধর সাপের কামড় মানেই অবধারিত মৃত্যু' এই চিন্তাধারায় সকলে দিশেহারা হয়ে উঠে। রোগীও অত্যাধিক উদ্বিগ্ন হয়ে যায় এর ফলে রোগীর নাড়ির গতি দ্রুত চক্তে থাকে। আবার রোগী বেশি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে যার ফলে রক্ত চাপ বেড়ে যায়। এর ফলে সাপের বিষ দ্রুত শরীরে মিশে যায়। তাই সাপ কামড়ালে করনীয় হলো রোগীকে আশ্বস্ত করা যে "সাপের কামড় মানেই মৃত্যু নয়"। ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সাপের কামড়ই নির্বিষ সাপের কামড়। এমনকি ৫০% বিষধর সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে মারাত্মক পরিমাণ বিষ শরীরে ঢোকে না। একে ডাক্তারি পরিভাষায় 'ড্রাই বাইট' বলে।
  • কাছাকাছি মানুষের সাহায্য নিন।
  • রোগীর নড়াচড়া বন্ধ করুন। হাত পা ভাঙ্গলে যেমন করে নড়াচড়া বন্ধ করা হয় ঠিক তেমনই শক্ত কাঠি দিয়ে হাত অথবা পা বেধে নড়াচড়া বন্ধ করতে হবে।
  • কোনো বাঁধা জিনিস যেমন চুড়ি, হাত ঘড়ি খুলতে হবে।
  • দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে পৌছান। সাপের কামড়ের মূল চিকিৎসাই হলো বিষের ওষুধ এভিএস। অর্থাৎ anti-snake venom serum যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে দিতে হবে। এই এভিএস সমস্ত সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে দেয়া হয়। তাই সাপে কামড়ালে রোগীকে তাড়াতাড়ি কাছের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। রোগী নিজে দৌড়ে বা সাইকেল চালিয়ে যাবেন না। একটি কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন যে এভিএস একটি অতি সাধারন ওষুধ, এটির প্রয়োগের জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা বিশেষ যন্ত্রপাতির কিছুই লাগে না।
  • ডাক্তার কে কেমন সাপ কামড়েছে তার বর্ননা দিন।

রাসেলস ভাইপার সহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপে কামড়ালে যা কখনোই করবেন না

  • কয়েকশো বছরের প্রচলিত অভ্যাস হলেও কোনো রকম বাঁধন দিবেন না।
  • কামড়ের যায়গায় কোনো রকম ছোপ বা কেমিক্যাল লাগাবেন না। বিষের জন্য কোনো ফোলা বা রঙ পরিবর্তন হলো কিনা, ওই ছোপ বা কেমিক্যাল এর জন্য বোঝার অসুবিধা হয়।
  • কামড়ের যায়গায় ঠান্ডা জল, বরফ বা গরম জল কোনো কিছুই উপকার করে না। উল্টো ক্ষতি হতে পারে। ধোয়ার চেষ্টা বা ঘষাঘসি করলে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
  • কেটে চিরে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না।
  • টেনে বা পাম্প করে বিষ বের করার চেষ্টা করবেন না।
  • জায়গাটি পোড়ানোর চেষ্টা করবেন না।
  • রোগী নিজে দৌড়ে বা সাইকেল চালিয়ে হাসপাতালে আসবেন না।

লেখকের মন্তব্য

আজকে আমরা রাসেলস ভাইপার সহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে কি করনীয় সম্পর্কে জানলাম। যদি আপনাদের আরো কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তবে নিচে কমেন্ট অপশনে আপনাদের মন্তব্য জানিয়ে দিন। আশা করি এখন আপনারা বুঝতে পেরেছেন রাসেলস ভাইপার সহ অন্যান্য বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে কি করনীয় তা সম্পর্কে। যদি আপনি এই পোস্ট থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন তবে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

কমেন্ট করুন

comment url