সাইনোসাইটিসের ৫টি লক্ষণ ও কারণ সমূহ বিস্তারিত জানুন

আমরা সচারাচর প্রায়ই মাথা ব্যাথায় ভুগে থাকি। সাধারন মাথা ব্যাথা ছাড়াও আমাদের আরও কিছু কারনে মাথা ব্যাথা হয়ে থাকে। যেমন দুশ্চিন্তার কারনে মাথা ব্যাথা, রক্তচাপের কারণে মাথা ব্যাথা। আবার কিছু মাথা ব্যাথা রয়েছে যেগুলো আমার-আপনার জন্য মারাত্মক হতে পারে। সাইনাস এর সমস্যা জনিত মাথা ব্যাথা যা সাইনোসাইটিস নামে পরিচিত এই ধরনের মাথা ব্যাথা হতে পারে আমাদের জন্য মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক। আজকে আমরা সাইনোসাইটিস কেন হয় ? সাইনোসাইটিস হলে করণীয় এবং সাইনোসাইটিসের ৫টি লক্ষণ ও কারণ সমূহ বিস্তারিত জানবো।
সাইনোসাইটিসের ৫টি লক্ষণ ও কারণ সমূহ


ভূমিকা

সচল মানবদেহের জন্য সুস্থ অঙ্গতন্ত্র প্রয়োজন। বিভিন্ন অঙ্গতন্ত্রের মধ্যে শ্বসনতন্ত্রের শ্বসন নালি অন্যতম প্রধান অঙ্গ। কিন্তু এ শ্বসননালী প্রায়ই ভাইরাসে, মাঝে মাঝে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সচল দেহকে প্রায় আধা-অচল করে দেয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা শ্বসননালির সংক্রমণকে দুই ভাগে ভাগ করে থাকেন। ১) উর্ধ্ব শ্বসননালিতে সংক্রমণ ( ফলে নাক, কান, গলা, সাইনাস আক্রান্ত হয়) এবং ২) নিম্ন শ্বসননালিতে সংক্রমণ ( ফলে শ্বাসনালি ও ফুসফুস আক্রান্ত হয়)। উর্ধ্ব শ্বসননালিতে সংক্রমণ রোগ গুলোর একটি হলো সাইনোসাইটিস। আজ আমরা সাইনোসাইটিস কেন হয় এবং সাইনোসাইটিস হলে করনীয় কি এবং সাইনোসাইটিসের ৫টি লক্ষণ ও কারণ সমূহ বিস্তারিত জানবো।

সাইনোসাইটিস কি ?

মাথার খুলিতে মুখ মন্ডলীয় অংশে নাসাগহ্বরের দুপাশে অবস্থিত বায়ু পূর্ন চার জোড়া বিশেষ গহ্বরকে সাইনাস বা প্যারান্যাসাল সাইনাস (paranasal sinus) বলে। এসব সাইনাস যদি বাতাসের বদলে তরলে পূর্ণ থাকে এবং সে তরল যদি জীবানুতে (ভাইরাস,ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক) সংক্রমিত হয় তখন সাইনাস এর মিকাস ঝিল্লিতে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের সংক্রমণে সাইনাসের মিউকাস ঝিল্লিতে সৃষ্ট প্রদাহকে সাইনোসাইটিস বলে। সাইনোসাইটিস ৮ সপ্তাহের কম সময় থাকলে তাকে একিউট সাইনোসাইটিস (acute sinusitis) এবং ৩ মাসের অধিককাল থাকলে তাকে ক্রনিক সাইনোসাইটিস (chronic sinusitis) বলে।

সাইনোসাইটিস কেনো হয় ?

  • সাইনাসগুলো বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ( Human respiratory syncytial virus, Para influenza virus, Metapneumo virus), ব্যাকটেরিয়া ( Streptococcus pneumoniae, Haemophilus influenzae) এবং কিছু ক্ষেত্রে ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হলে সাইনোসাইটিস হতে পারে।
  • ঠান্ডাজনিত কারণে।
  • এলার্জিজনিত কারণে।
  • ব্যবধায়ক পর্দার অস্বাভাবিকতায় সাইনাস গহ্বর অবরুদ্ধ হয়ে।
  • নাকে পলিপ (plyp) সৃষ্টির কারনে।
  • নাসাগহ্বরের মিউকোসা স্ফীতির ফলে নাসাপথ সরু হয়ে ক্রনিক সাইনোসাইটিস হতে পারে।
  • দাঁতের ইনফেকশন থেকে বা দাঁত তুলতে গিয়ে সাইনাসে সংক্রমণ হতে পারে।
  • যারা হাঁপানির সমস্যায় ভোগে তাদের দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিস দেখা যায়।
  • সাধারনত ঘরের পোকামাকড়, ধুলাবালি,পেস্ট, তেলাপোকাজনিত বায়ুদূষণ যেসব এলার্জেন ধারন করে তাদের প্রভাবে এ রোগের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।
  • ইউস্টেশিয়ান নালির (custachian tube) সামান্য অস্বাভাবিকতায় সাইনাস গহ্বর অবরুদ্ধ হয়ে এবং সংক্রমণের ফলে সাইনোসাইটিস হতে পারে।

সাইনোসাইটিসের ৫টি লক্ষণ সমূহ

  • নাক থেকে ঘন ঘন তরল বের হতে থাকে। এটি সাধারণত হলদে বা সবুজ বর্ণের হয় এবং তাতে পুজ বা রক্ত থাকতে পারে।
  • তীব্র দীর্ঘ ও বিরক্তিকর মাথাব্যথা লেগে থাকে যা সাইনাসের বিভিন্ন অঞ্চলে হতে পারে।
  • মাথা নাড়াচাড়া করলে হাঁটলে বা মাথার নিচু করলে ব্যথার তীব্রতা আরো বেড়ে যায়।
  • জ্বর জ্বর ভাব থাকে কোন কিছুতেই ভালো লাগেনা এবং অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়।
  • নাক বন্ধ থাকে নিঃশ্বাসের সময় নাক দিয়ে বাজে গন্ধ বের হয়।

সাইনাস ইনফেকশন কতটা ক্ষতিকর?

সাইনোসাইটিস সংক্রান্ত জটিলতা বাইয়ের ক্ষতি কেবল নাসিকা গহ্বর ঘিরেই অবস্থান করে না। সাইনাস গুলোর অবস্থান চোখ ও মস্তিষ্কের মত অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গের সংলগ্ন হওয়ায় জীবন সংক্রমণ শুধু সাইনাসে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং রক্তবাহিত হয়ে চোখ ও মস্তিষ্কে পৌঁছালে মারাত্মকতা সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কে সংক্রমণের ফলে মাথা ব্যথা দৃষ্টিহীনতা থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে চোখের সংক্রমণের ফলে পেরিয়ে অরবিটাল ও অরবিটাল সেলুলাইটিস সহ আরো অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

সাইনোসাইটিস হলে কি কি খাওয়া যাবে না?

হলে বেশ কিছু খাবার না খাওয়াই ভালো এ খাবার গুলো খাবার কারনে সাইনাসের ভিতরে প্রদাহ হতে পারে কিছু খাবারের তালিকা নিচে দেওয়া হল যেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে-
  • দুধ ও দুধ জাতীয় খাবার: সাইনোসাইটিস হলে দুধ দই পনির মাখন ঘি ইত্যাদি খাবার থেকে বিরত থাকা উচিত। এগুলো মিউকাসের বা কফের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় যার ফলে সাইনোসাইটিস আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
  • মিষ্টি জাতীয় খাবার: সাইনোসাইটিস হলে অতিরিক্ত চিনি এবং চিনি জাতীয় খাবারগুলো পরিহার করা উচিত মিষ্টি জাতীয় খাবার খেলে আক্রান্ত স্থানে প্রদাহ বাড়তে পারে।
  • অ্যালকোহল সেবন: সাইনোসাইটিস হলে মদ বা অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। এটি মিউকাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং সাইনাসের প্রদাহকে বাড়িয়ে দেয়।
  • ভাজা এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার: বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড ভাজাপোড়া অথবা প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার সাইনাসের প্রদাহ বাড়িয়ে দিতে পারে তাই এ সকল খাবার পরিহার করা উচিত।
  • কফি এবং ক্যাফেইন জাতীয় খাবার: কফি এবং ক্যাফেন জাতীয় খাবার আমাদের শরীরের পানির পরিমাণ কমিয়ে দেয় যার ফলে মিউকাস ঘন হয়ে যায়।
  • ঠান্ডা খাবার: ঠান্ডা খাবার পরিহার করতে হবে। এগুলো সাইনাসের প্রদাহ বাড়িয়ে তুলে।

সাইনাস ইনফেকশন হলে কি সর্দি লাগে?

সাইনাস ইনফেকশন বা সাইনোসাইটিস হলে সর্দি লাগে। সাইনোসাইটিসের সময় সাইনাসের ভিতরে cavity গুলোতে প্রদাহ হয়ে থাকে যার ফলে মিউকাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর কারণে সর্দির উপসর্গ দেখা দেয়।

সাইনাস ইনফেকশনের সবচেয়ে খারাপ দিন কোনটি?

সাইনাস ইনফেকশনের সবচেয়ে খারাপ দিন বলতে সর্বোচ্চ প্রদাহের দিনগুলোকে বুঝায়। এ সময় সংক্রমণের কারণে সাইনাসের প্রদাহ অনেক বেড়ে যায় এবং নিউক্লাসের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি থাকে। এর ফলে সাইনাস ইনফেকশন অনেক জটিল আকার ধারণ করে। সাধারণত সংক্রমনের তৃতীয় দিন থেকে পঞ্চম দিন পর্যন্ত এই উপসর্গগুলো তীব্র আকার ধারণ করে বিশেষ করে তীব্র মাথাব্যথা নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া মুখে ব্যথা ও চাপ অনুভব করা গলা ব্যথা ও কাশি হওয়া কফের রং পরিবর্তন হওয়া গন্ধ ও স্বাদ পরিবর্তন হওয়া।

সাইনাস ইনফেকশন হলে কি কাশি হয়?

জি হ্যাঁ, সাইনাস ইনফেকশন হলে যন্ত্রণাদায়ক কাশি হতে পারে। সাইনাস ইনফেকশন হলে মিউকাস বা কফ এর পরিমাণ অনেক বেড়ে যায় এর ফলে নাক থেকে গলার পিছনে মিউকাস গুলো গড়িয়ে পড়ে এবং গলার পিছনে জমা হয়ে গলা ব্যথা কাশি ফুসফুসে কাশি সৃষ্টি করে। এ ধরনের কাশিগুলো রাতে এবার সকালে বেশি হতে পারে শোয়ার সময় মিউকাস গলায় জমা হয়।

সাইনাস ইনফেকশন হলে কি কানে ব্যথা হয়?

সাইনাস ইনফেকশন হলে কানে ব্যথা হয়। সাইনাস এবং কান একে অপরের সাথে সংযুক্ত তাই সাইনাসে ইনফেকশনের ফলে কানে চাপসহ ব্যথা অনুভূত হয়। সাইনাস ইনফেকশন হলে অতিরিক্ত মিউকাস ইউস্টেশিয়ান নালী ব্লক করে দেয় যার ফলে কানে ব্যথা অনুভূত হয়।

সাইনোসাইটিস এর প্রতিকার

স্বেচ্ছা সতর্কতা: সাইন আছে জমাট বেঁধে অবস্থিত তরলকে বিগলিত করে সাইনাস কে চাপমুক্ত ও স্বাভাবিক রাখতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
গরম পানিতে ভিজিয়ে চিপে একখন্ড কাপড় প্রতিদিন বারবার মুখমন্ডলে চেপে ধরা, মিউকাস তরল করতে প্রচুর পানি পান করা, প্রতিদিন দুই থেকে চারবার নাক দিয়ে বাষ্প টেনে নেয়া, দিনে কয়েকবার ন্যাজাল স্যালাইন স্প্রে করা, আর্দ্রতা প্রতিরোধক ব্যবহার করা, যন্ত্রের সাহায্যে নাকের ভিতর সবেগে পানি প্রবাহিত করে সাইনাস পরিষ্কার রাখা, বন্ধ নাক খোলার জন্য ন্যাজাল স্প্রে ব্যবহারে সতর্ক থাকা, নাক বন্ধ অবস্থায় উড়োজাহাজে না চড়াই ভালো, মাথার নিচু করে শরীর বাঁকানো অনুচিত।
ওষুধ প্রয়োগ: একিউট সাইনোসাইটিসের চিকিৎসায় ওষুধের দরকার হয় না তবে প্রয়োজনে দুই সপ্তাহের চিকিৎসা চলতে পারে। ক্রনিক সাইনোসাইটিসের চিকিৎসা চলে তিন থেকে চার সপ্তাহ। ছত্রাকজনিত সাইনোসাইটিসের চিকিৎসায় বিশেষ ধরনের ওষুধ ব্যবহৃত হয়। এন্টিবায়োটিক সহ সমস্ত ওষুধ ব্যবহারে চিকিৎসকের পরামর্শ ও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী হতে হবে।
কোন শিশু যদি নাক দিয়ে তরল নির্গমনসহ দুই থেকে তিন সপ্তাহ ধরে কাশিতে, ১০২.২ ডিগ্রি ফারেনহাইট জ্বরে, মাথা ব্যথা ও প্রচন্ড চোখ ফোলা অসুখে ভোগে তাহলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নির্দেশে এন্টিবায়োটিকের প্রয়োগ শুরু করতে হবে।

লেখকের মন্তব্য

আজকে আমরা সাইনোসাইটিস কেন হয় ? সাইনোসাইটিস হলে করণীয় এবং সাইনোসাইটিসের ৫টি লক্ষণ ও কারণ সমূহ বিস্তারিত জানলাম। যদি আপনাদের আরো কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তবে নিচে কমেন্ট অপশনে আপনাদের মন্তব্য জানিয়ে দিন। আশা করি এখন আপনারা বুঝতে পেরেছেন সাইনোসাইটিস কেন হয় ? সাইনোসাইটিস হলে করণীয় এবং সাইনোসাইটিসের ৫টি লক্ষণ ও কারণ সমূহ বিস্তারিত সম্পর্কে । যদি আপনি এই পোস্ট থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন তবে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

কমেন্ট করুন

comment url